প্রতি বুধবার রাত ১০টায় আসে লোকটা। লাশ নিতে। একটা লাশ নিয়ে যায় এবং তাকে দিয়ে যায় নগদ ১ হাজার দিনার। কোনো ঝামেলা করে না। তাদের একটাই শর্ত, লাশটা হতে হবে পুরুষের লাশ এবং সব অঙ্গ সম্পূর্ণ অক্ষত থাকতে হবে।
সে নিজ হাতে দাফন করা লাশগুলো থেকে বেছে বেছে পুরুষ এবং অক্ষত লাশগুলো বিক্রি করে দেয়। প্রতি সপ্তাহে একটা, বুধবার রাত ১০টায়। অনেক বছর ধরে সে গোরস্থানে গোরখোদকের কাজ করছে। সবাই তাকে একজন সাচ্চা ঈমানদার লোক হিসেবেই জানে, খোরখোদে ন্যায্য মজুরির বেশি এক পয়সাও দাবি করে না। কেউ টের পায় না, ভালো অক্ষত লাশগুলো সে কবর দেয় বিশেষ এক কায়দায়। হালকা করে মাটি চাপা দেয়। বুধবার রাতে সেই লাশ তুলতে তার তেমন বেগ পেতে হয় না। অপরিচিত এক লোকের হাতে সেই লাশ তুলে দিয়ে ন্যায্য মজুরির বাইরে আরেকটা চড়া মজুরি জোটে গোরখোদকের।
মাসে মাসে বাড়ছে লাশের দাম। কারণ অক্ষত পুরুষ লাশ সুলভ কিছু নয়। এখন অক্ষত পুরুষ লাশ খুবই দুর্লভ। পুরুষ লাশগুলো অধিকাংশই থাকে হয়তো হাতকাটা, না হয় পা থেঁতলানো, মস্তকহীন বা চোখ উপড়ানো...। তবে বুধবারের জন্য একটা অক্ষত পুরুষ লাশ সে বের করে ফেলে। বুধবার রাতে নির্ধারিত সময়ে লোকটা এসে ঠিক উপস্থিত হয়। লাশ দিয়ে সে তার পাওনা গুণে নেয় অনায়াসে।
লাশগুলোর কী হয়, তারা এগুলো দিয়ে কী করে, এটা তার জানা নেই। জানতেও চায়নি কোনো দিন। আরে ভাই রুহু বাইর হোয়া যাওনের পর মরার কী হইল না হইল তাতে কী আসে যায়?! বছর বছর বাড়ছে গোরখোদকের সম্পদের পরিমাণ। কিছু দিন আগে সে শহরে একটা দালান কিনল। তিন তলা দালান। প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর প্রতি তলা থেকে ভাড়া পাচ্ছে। ১২টা ভাড়া গাড়ি নামিয়েছে। দিনান্তে প্রতি গাড়ির ভাড়া বাবদ পাচ্ছে নয় দিনার। কোনো ঝুটঝামেলা নেই। ড্রাইভারদের সাথে তার ভালো সম্পর্ক। কোনো ঝগড়াঝাঁটি নেই এবং পাড়া প্রতিবেশীদের সন্দেহ নেই যে, গোরখোদক ‘জাইয়াশ আবু রুমানা’ একজন শরিফ, আমানতদার এবং সাচ্চা ঈমানদার মানুষ। কোনো জিন-ইনছান জানতে পারে না তার এই গোপন কারবারের কথা। কারবার শুরু করার চার বছরের মাথায় সে দ্বিতীয় দালানটা কিনল। চার তলার দালান। সামনে সুন্দর বিশাল একটা বাগান। দালানের শিশু রাত-দিন বাগানটায় পড়ে থেকে খেলে, হুড়োহুড়ি করে।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় গোরখোদক চায়ের দোকানে বসে। মনোযোগ দিয়ে লোকজনের শরীর মাপে। মনে মনে ভাবে, সবই বিকাইবো ভালো, তবে মরতে আরো অনেক দেরি।
তার এই গোরখোদা এবং লাশ ব্যবসার কারবার শুরু কারার অনেক বছর পর এক বছর এপ্রিল মাসের প্রথম বুধবার, যে লোক এত বছর লাশ নিতে আসত সে আর এলো না। তবে নির্ধারিত সময় অন্য আরেকটা লোক তার সামনে এসে দাঁড়াল। ভাবিক সুরে বলল
কেমন আছেন জাইয়াশ? আবদুল আব্বাস নামের যে লোক কয়েক বছর ধরে আপনার কাছ থেকে লাশ নিয়ে যেত সে গত সপ্তাহে মারা গেছে। তার জায়গায় তারা আমাকে পাঠিয়েছে। কোনো কিছুই বদলায়নি। এখন থেকে তার মতো প্রতি বুধবার রাতে আমি লাশ নিতে আসব।
গোরখোদকের মাথার চার পাশে ভন ভন করে ঘুরতে শুরু করল একঝাঁক সন্দেহ। সে তাড়াতাড়ি বলল
কী বলতাছেন এই সব? কিছুই তো বুঝতে পারতাছি না!
লোকটা তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল, ¯ভাবিক সুরে বলল
জাইয়াশ সাহেব ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি সব জানি। আমিও তাদের লোক। মনে রাখবেন আমাদের আপনার দরকার আছে
জাইয়াশের শিরায় শিরায়, প্রতিটি রোমকুপে সন্দেহ ঢুকে পড়েছে। তার পরও সে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল
কী জানেন আপনে? কী চান আমার কাছে? আবদুল আব্বাস কে? আমি তারে চিনি না, এসবের লগে আমার কোনো সম্পর্ক নাই।
লোকটা বিনা দ্বিধায় এবং ভাবিক কণ্ঠে বলল
আমরা বুধবারের লাশ চাই। আজ থেকে আপনার হিসাব-নিকাশ আমার সাথে হবে।
জাইয়াশ উঠে দাঁড়াল এবং অদ্ভুতভাবে বলল
কালকা আইসেন, এখন আপনে এই সব কী বলতাছেন আমি বুঝতে পারতাছি না। একটা কাক, বা কাকের মতো দেখতে কোনো পাখি, তাদের সামনে এসে বসল। বসে থাকল নির্ভয়ে। লোকটা প্রায় চিৎকার করে বলল
আজ আমি যা বলছি কাল এলে ঠিক একই কথা বলব।
দেখেন ভাই সবাই জানে আমি ঈমানদার মানুষ। আপনি আমার কাছে কী চান আমি বুঝতে পারতাছি না। বুঝতেও চাই না, আপনি আর কোনো দিন আমার কাছে আসবেন না...
জাইয়াশ সারি সারি কবরের মাঝ দিয়ে ছুটতে ছুটতে বাড়ি চলে গেল। তার মনে হলো তার পেছনে পেছনে ছুটছে গোরস্থানের শত শত লাশ।
কাকের মতো দেখতে সেই পাখিটা নির্ভয়ে বসে থাকল সেই জায়গাতেই।
রাতে তাকে ভয় পেয়ে বসল ভালোভাবেই। অস্থির হয়ে এক পর্যায় ছুটে গেল গোরস্থানে। লাশ বিক্রি করে দেয়া কবরগুলো দেখল ঘুরে ঘুরে। নেমপ্লেটের নাম-ঠিকানা পড়ল মনোযোগ দিয়ে। ভাবতে লাগল কোথায় গেছে এই লাশগুলো। তারা কী করেছে লাশগুলো নিয়ে? এদের আত্মীয় যদি জানতে পারে... কী হবে তাহলে?... আলপিন ফুটা চাদরের মতো ভয় ঘিরে ধরল তাকে। মাঝরাতে বাড়ি ফিরে এলো। ঘুম নেই। বিছানায় পড়ে অনেকক্ষণ ছটফট করে আবার গেল গোরস্থানে। প্রথম ফজরের দিকে ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে বাড়ি ফিরে এলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে ঠা মাথায় ভাবল
এমনও তো হতে পারে এই নতুন লোকটা এই লাইনেরই অন্য কোনো ব্যবসায়ী! সে আবদুল আব্বাসের জায়গা দখল করতে চাচ্ছে। লাশ ব্যবসা তো এখন মামুলি ব্যাপার, বাজারের অন্যান্য কারবারের মতোই সাধারণ একটা কারবার। লাশ তো এখন বেগুন, জামা-কাপড়, তরমুজ, গাড়ির টায়ার... এই জাতীয় পণ্যের মতোই একটা পণ্য হয়ে গেছে।
গোরস্থানে ঘুরে ঘুরে লাশ বিক্রি করে দেয়া কবরগুলোর নেমপ্লেটগুলোর দিকে তাকিয়ে গোরখোদক প্রায় সশব্দে ভাবতে লাগল
এই দুনিয়াতে আমার আর কী পাওনের আছে, দুইটা দালান, ১২টা ভাড়া গাড়ি, ব্যাংকে আছে অনেক টাকা, বছরে বছরে বাড়তাছে। আমি তো এখন হিসাবই করতে পারি না কত ধনের মালিক আমি। এর চেয়ে বেশি আর কী চাই আমি?।
গোরখোদক সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিলো, লাশ বিক্রির কারবার ছেড়ে দেবে। আর কখনো এই পাপ করবে না। বরং অচিরেই সে হারাম শরীফ সফর করে আসবে। নামের শুরুতে ‘আল-হাজ’ উপাধি লাগাতে হবে। উপাধিটা নিশ্চয়ই বাকি জীবন তাকে নিরাপদ রাখবে। কারো মনে কখনো এই সন্দেহের উদয় হবে না যে, ‘আল-হাজ’ জাইয়াশ আবু রুমানা লাশ বিক্রির কারবার করে। তাকে যারা চেনে কারো পক্ষে কোনোভাবে তা বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। কারণ তার ভাবজাত চতুরতায় সে এসব কিছুই গোপন রেখেছে নিখুঁতভাবে। সে যে ছুকুশ্ শায়েখে একটা দালান তারপর বাগদাদের শেষ মাথায় দ্বিতীয় আরেকটা দালান কিনেছে সেটা একটা কাকও টের পায়নি। নানান ব্যাংকে জমতে থাকা তার টাকার খবর কারো জানা নেই। জাইয়াশ তার গাড়ির কাফেলা নামিয়েছে তার গোরস্থান থেকে কয়েক শ’ কিলোমিটার দূরে বসরার রাস্তায়। তিকরিত ও নিনওয়ায় নানা কারবারে খাটিয়ে রাখা তার টাকার কথাও কারো জানা নেই। দুই বছর আগে যখন সে দামেস্ক সফরে গেল তখন সেখানে লুকিয়ে রেখে এসেছে অনেক ধন... সুতরাং এদের কারো পক্ষে সহজে এই পর্দা ভেদ করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া ঈমানদার গোরখোদক জাইয়াশ সব সময় গোরস্থানের মাটির মতো ছাই রঙা এবং ময়লা মোটা একটা পশমি চাদর গায়ে দিয়ে থাকেন। সাধারণ কোনো বাতাসে উড়বে না এই ভারী পর্দা!!
এরপর দিন লোকটা তার বাসায় এসে উপস্থিত। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে জাইয়াশের ভয়ে প্রায় জমে যাওয়ার অবস্থা। কিন্তু লোকটা বেশ ভদ্র ভাষায় বলল
জাইয়াশ সাহেব আছেন? ভাইজান বিশ্বাস করুন আমি মরহুম আবদুল আব্বাসের জায়গায় কাজ করছি। অন্য কিছু না। আমাদের যেমন আপনাকে দরকার তেমনি আপনারও দরকার আমাদের।
দরজার ওপার থেকে আতঙ্কিত কণ্ঠে জাইয়াশ বলল
আমার কারোরে দরকার নাই, আপনি কী চান, কী বলতাছেন আমি কিছুই জানি না।
দরজা খোলার পর গোরখোদকের আতঙ্কিত চেহারা দেখে লোকটা হাসতে হাসতে বলল
বুধবারের লাশ জাইয়াশ সাহেব! আমরা বুধবারের লাশ চাই। আর কিছু না। ওটাতে আমাদের হক বেশি, তাতে যেন অন্য কোনো বেপারী ভাগ না বসায়। আপনার মনে যদি কোনো সন্দেহ থেকে থাকে তাহলে বলুন প্রমাণ করে দিচ্ছি আপনি যে আশঙ্কা করছেন আমরা সেই লোকদের কেউ নই। আপনি আমাদের কাছে প্রতি বুধবারে লাশ বিক্রি করতেন। এখনো করবেন এবং আগের মতোই নগদ টাকা পাবেন। ব্যস। কোনো কিছুই বদলায়নি।
জাইয়াশ বেশ হালকা বোধ করতে লাগল, গায়ে ফুটে থাকা আলপিনগুলো ধীরে ধীরে উঠে যেতে লাগল, গোরস্থানের ভারী অস্তিকর বাতাসটাও কেটে গেল। মনে হচ্ছে সব কিছু আবার আগের মতোই চলতে থাকবে। তার আর হারাম শরিফ জিয়ারতে যেতে হবে না। বরং লাশের জন্য বেপারীদের ছটফটানি দেখে মনে হচ্ছে অচিরেই সে তৃতীয় আরেকটা দালান কিনতে পারবে।
জাইয়াশ ফুরফুরে মনে গোরস্থানে গেল। শেষ মাথার সবচেয়ে নতুন কবরটা খুঁড়ে মরহুম আবদুল আব্বাসের স্থানে আসা নতুন লোকটার হাতে লাশ তুলে দিলো, গুনে নিলো নগদ ১ হাজার দিনার ফেরিওয়ালার কাছে পুরান জুতা জোড়া বিক্রি করে দেয়ার মতো।
এত টাকায় লাশ কিনে তার কী করে? এই রহস্যটা সে এখনো আবিষ্কার করতে পারল না এবং গোরখোদক জাইয়াশের পক্ষে আর কোনো দিন এই অদ্ভুত বিষয়টির রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে না। শেষ রাতে জাইয়াশ গোরস্থানের সারি সারি কবরগুলোর মাঝখানে পায়চারি করছিল, গোরস্থানটা প্রায় পুরুষ লাশশূন্য হয়ে গেছে, এটাকে এখন নারী গোরস্থান বলা যায়। প্রথম লাশ বিক্রির ঘটনাটা মনে পড়ল। সে দিনের মতো আজো গায়ে কাটা দিলো। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে আনমনে পায়চারি করছে গোরখোদক জাইয়াশ। আজ যে কবর খুঁড়ে লাশ বের করেছে কবরটা এখনো খোলা। বেখেয়ালে পায়চারি করতে থাকা জাইয়াশ রাতের অন্ধকারে সেই কবরে গিয়ে পড়ল।
এক সপ্তাহ পর সেই লোকটা এলো, রাত ১০টায়, বুধবারের লাশ নিতে। কিন্তু জাইয়াশকে পাওয়া গেল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে লোকটা গোরস্থানে পায়চারি করতে লাগল, জাইয়াশ নিশ্চয়ই এসে পড়বে! হঠাৎ তার নজর পড়ল একটা খোলা কবরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে জাইয়াশ। সে যখন নিশ্চিত হয় যে, জাইয়াশ মরা তখন তাকে কাঁধে নিয়ে এক দৌড়ে গোরস্থানের গেটের সামনে দাঁড় করানো পিকাপে নিয়ে তুলল। খুশিতে তার প্রায় নাচুনে দশা। হাসতে হাসতে ড্রাইভারকে বলল
আজ মাগনা লাশ!
আবদুস সাত্তার নাছের ইরাকের প্রখ্যাত সাহিত্যিক। আধুনিক আরবি সাহিত্যে তার অসাধারণ কর্মে আরব বিশ্বেও তিনি সমান জনপ্রিয়
No comments:
Post a Comment